আজকের আলোচনার বিষয়ঃ কাউন্সেলিং এর মূলনীতি । যা পেশেন্ট কেয়ার টেকনিক ১ এর কমিউনিকেশন এন্ড কাউন্সেলিং অংশের অন্তর্গত।

কাউন্সেলিং এর মূলনীতি
কাউন্সেলিং একটি পেশাগত প্রক্রিয়া। দৈনন্দিন জীবনে আমরা নানা বিষয়ে যে সাধারণ উপদেশ, নির্দেশ বা পরামর্শ দিয়ে থাকি তা থেকে এটি সম্পূর্ণ ভন্নি । কাউন্সিলিং সেবায় গবেষণা এবং বিশেষজ্ঞের অভিজ্ঞতার আলোকে সেবা গ্রহীতাকে একটি পদ্ধতিগত প্রক্রিয়া অবলম্বন করে সহায়তা প্রদান করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় সে জন্য কতকগুলো পেশাগত নীতি রয়েছে-

গ্রহণযোগ্যতা বা Acceptance :
কাউন্সেলিং-এ প্রতিটি মানুষ একজন স্বতন্ত্র ব্যক্তি। প্রত্যেক সেবা গ্রহীতাকে একজন একক ব্যক্তি হিসেবে গ্রহণ করা এবং সেই অনুযায়ী কাউন্সেলিং প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করাও একটি প্রক্রিয়াগত নীতি। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ব্যক্তির বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য, অর্থনৈতিক শক্তি, শিক্ষাগত যোগ্যতা, ধর্ম, শ্রেণিভেদে ব্যক্তির প্রতি ইতিবাচক বা নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করা যাবে না ।
সংহতিপুর্ণতা বা Solidarity:
কাউন্সেলিং প্রক্রিয়ায় সংহতিপূর্ণতা বা Solidarity একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি। এই নীতির আওতায় কাউন্সিলর সেবা গ্রহীতার প্রতি কতকগুলো নির্দিষ্ট বিষয়ে একই রকম ধারণা পোষণ করেন এবং সম্পর্ক বজায় রাখান। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত কাউন্সিলর ও সেবা গ্রহীতার মধ্যে স্বচ্ছতা, সততা, দায়িত্ববোধ, শ্রদ্ধা এবং পেশাগত মনোভাব বজায় রাখতে হয়।
গোপনীয়তা বা Confidentiality:
সেবা গ্রহীতার তথ্যাদির গোপনীয়তা বজায় রাখা কাউন্সেলিং- এর একটি অন্যতম পেশাগত নীতি। এই নীতির আওতায় সেবা গ্রহীতাকে নিশ্চিত করতে হবে যে তার দেওয়া তথ্য সর্বদা গোপন রাখা হবে। সেবা গ্রহীতার বিশ্বাস অর্জনই সফল কাউন্সেলিং- ২-এর প্রধান শর্ত। কাউন্সিলিং-এ তথ্যাদির গোপনীয়তা রক্ষার প্রধান উদ্দেশ্য সেবা গ্রহীতার সম্মান বজায় রাখা এবং অন্যান্য মানসিক, শারীরিক ও সামাজিক সম্ভাব্য নেতিবাচক ঝুঁকি থেকে সেবা গ্রহীতাকে মুক্ত রাখা। কিছু কিছু ক্ষেত্রে যেমন সেবা গ্রহীতার আত্মহত্যার প্রবণতা বা যেখানে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন, সেসব ক্ষেত্রে সেবা গ্রহীতার অনুমোদন সাপেক্ষে ‘যতটুকু তথ্য না দিলেই নয়’ এই নীতি অনুসরণ করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা সংস্থাকে তথ্য সরবরাহ করা।

নৈর্ব্যক্তিকতা বা Objectivity:
কাউন্সেলিং সেবায় সেবা গ্রহীতা সম্পর্কে কোনো পক্ষপাতিত্বমূলক মনোভাব পোষণ করা যায় না। সেবা গ্রহীতা সম্পর্কে কোনো রকম ঔফমবসবহঃধষ না হওয়া অর্থাৎ সেবা গ্রহীতার ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য যেমন ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, সামাজিক, অর্থনৈতিক অবস্থা দিয়ে বিচার না করা। এই নীতির আওতায় সেবা গ্রহীতার ব্যক্তিগত তথ্যাদির ভিত্তিতে কাউন্সিলর সেবাদান প্রক্রিয়ায় কোনো বৈষম্যমূলক আচরণ করবেন না। অথবা নিজস্ব, ধর্মীয় বা আদর্শগত বা মানসিক অবস্থার তারতম্য দ্বারা সেবা গ্রহীতার সাথে সম্পর্ক এবং মনোভাবে অসম আচরণ করবেন না।
কাউন্সেলিং এপ্রোচ বা প্রসেস:
কাউন্সেলিং এপ্রোচ বা প্রসেস বলতে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কাউন্সেলিং-এর ধারাবাহিক পদ্ধতিটিকে বুঝানো হয়। কাউন্সেলিং-এর দুটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া খুবই কার্যকরিঃ REDI ও GATHER. মূলত প্রজনন স্বাস্থ্য সেবায় এই এপ্রোচ দুটি ব্যাবহৃত হলেও আমাদের বয়স্ক সেবাদানের ক্ষেত্রেও মূল বৈশিষ্টটি একইরকম। প্রায় সকল ধরনের কাউন্সেলিং-এর ক্ষেত্রেই এই দুটি মৌলিক উপায় অবলম্বন করা হয়। নিচে REDI সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা প্রদান করা হল:
R: Rapport Building (সুসম্পর্ক স্থাপন):
এটি হচ্ছে দুজন বা ততোধিক ব্যক্তির মধ্যে নির্ভরযোগ্য সম্পর্ক তৈরির প্রক্রিয়া। যিনি কাউন্সেলিং করবেন তার সাথে কাউন্সেলিং প্রাপ্ত ব্যক্তির একটি বন্ধুসুলভ সুসম্পর্ক তৈরি হওয়া খুবই বাঞ্চনীয় এবং এটি কাউন্সেলিং এর পূর্বশর্ত। সমস্যাগ্রস্ত একজন ব্যক্তি তার সমস্যার কথা তখনই বলতে চাইবেন যখন তিনি আস্থা পাবেন যে তার সমস্যাটি নিয়ে কেউ ঠাট্টা-মশকরা করবেনা কিংবা হেও প্রতিপন্ন করবেনা। বরং তার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনবে, মনের কথাগুলো গোপন রাখবে ও সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদানের চেষ্টা করবে।
এই সম্পর্কের ভিত্তি হলো শর্তহীন ইতিবাচক সম্মান, নিখুঁত সমানুভূতি ও অকৃত্রিমতা। সম্পর্কটি আগেভাগেই প্রতিষ্ঠিত করতে হবে কেননা এই সম্পর্কের মাধ্যমেই জানা যাবে ক্লায়েন্ট কাউন্সেলিং প্রক্রিয়াটিতে আদৌ যোগ দেবে কিনা এতে যুক্ত হলেও চালিয়ে যাবে কিনা। প্ৰাথমিক পর্যায়ের সাক্ষাৎকারগুলোর অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য নিম্নরুপঃ
ক. ক্লায়েন্টের সঙ্গে সুসময় ও ইন্তিবাচক সম্পর্ক স্থাপন
খ. ক্লায়েন্টকে কাউন্সেলিং প্রক্রিয়া ও তাতে পারস্পরিক দায়-দায়িত্ব কী তা পরিষ্কার করে বোঝান
গ. কথোপকোথন যাতে নির্বিঘ্নে ঘটে তাতে ক্লায়েন্টকে সহায়তা করা। ঘ. ক্লায়েন্ট বিশেষ কোনো চাদিহা সম্পন্ন হলে সেটি বিবেচনায় আনা।

E: Exploration (চাহিদা নিরূপন):
সম্পর্ক স্থাপনের পর দ্বিতীয় স্তরে ক্লায়েন্টকে তার সমস্যাটি ঠিক কী তা গভীরভাবে চিন্তা করে কাউন্সিলরের নিকট উপস্থাপন অনেকটাই সহজ হয়ে যায়। এই স্তরে ক্লায়েন্টের দ্বায়িত্ব অনেক বেশি। সমস্যার স্বরূপটি যতটা সহজ ও সুন্দরভাবে সে তুলে ধরতে পারবে কাউন্সেলরের পক্ষেও তাকে সাহায্য করা ততটা সহজ ও সুবিধাজনক হবে। অনুসন্ধানের মাধ্যমে সমস্যা চিহ্নিতকরণে নিম্নলিখিত স্তরগুলো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্যঃ
ক) সমস্যার সংজ্ঞা প্রদানঃ
ক্লায়েন্টের সাথে সহমর্মী ও সমমনস্ক হয়ে সমস্যাটি বস্তুনিষ্ঠভাবে এবংবিশেষায়িত করে বর্ণনা ও চিহ্নিত করা হয়। এটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ক্লায়েন্ট ও কাউন্সিলর যেন সমস্যাটি বস্তুনিষ্ঠভাবে একই দৃষ্টিকোণ থেকে নিরীক্ষন করে।
খ) সমস্যাটির বিভিন্ন দিক খুঁটিয়ে দেখাঃ
সমস্যাটি ভালোভাবে বুঝার জন্য যে সব তথ্য সংগ্রহ করা দরকার সেগুলো এই স্তরে সংগ্রহের উপায় ভাবা হয়। কে, কীভাবে ও কত সময়ের মধ্যে এই তথ্যসমূহ সংগ্রহ করতে পারবে ইত্যাদিরও চিন্তা ভাবনা করা হয় এই স্তরে।
গ) তথ্যের সমন্বয়সাধনঃ
এই স্তরে গৃহীত সমস্ত তথ্য সুবিন্যস্ত করে সাজিয়ে ক্লায়েন্টের সমস্যার স্বরূপট উদঘাটিত করা হয়।

D: Decision making (স্বিদ্ধান্ত গ্রহণ):
ক্লায়েন্ট কেন কাউন্সেলিং-এর জন্য এলেন সে বিষয়ে যখন কাউন্সলর সমস্ত তথ্য সংগ্রহে সমর্থ হলেন এবং ক্লায়েন্টও সমস্যার রূপরেখা বুঝতে পেরে তা সমাধানে তৎপর হলেন, তখন কাউন্সিলর ও ক্লায়েন্টের যৌথ উদ্যোগে সমস্যা সমাধানের পরিকল্পনা তৈরি হবে। সমস্যা সমাধানের স্তরসমূহ নিম্নরুপঃ
ক) সম্ভাব্য সকল সমাধানসমূহ চিহ্নিতকরণ ও নথিভুক্তকরনঃ ক্লায়েন্ট ও কাউন্সিলর ব্রেইনউর্সিং-এর মাধ্যমে যতরকম সমাধান সূত্র বের করা যায় তার চেষ্টা করবেন। অবশ্য ক্লায়েন্টকে এ ব্যাপারে বেশি উদ্যোগ নিতে হবে। সমস্যা সমাধানের সুরসমূহ নথিভুক্তকরণের সময় এমন কোনো সমাধানসূত্র বাদ দেওয়া চলবেনা যা প্রথনদৃষ্টিতে মনে হবে যেন তা বাস্তবে প্রয়োহ করা সম্ভব নয়।
খ) এ স্তরে কাউন্সিলরের পরামর্শ অনুযায়ী ক্লারেন্ট প্রতিটি সমাধানের পথ কিভাবে কাজে লাগানো যেতে পারে তা খতিয়ে দেখবেন। এ সময় ক্লায়েন্টের কাছে কিছু কিছু পথ জটিল মনে হতে পারে আবার কিছু কিছু উপায় বাঘৰে প্রয়োগ করা একেবারেই অসম্ভব বলে মনে হবে। তারপরেও সবগুলো সম্ভাবনা খুব যত্নসহকারে যাচাই করে দেখতে হবে।
গ) ক্লায়েন্ট কাউন্সিলরের পরামর্শ অনুযায়ী এবার সমাধানের উপায় গুলোকে সহজতম থেকে কঠিনতম ক্রম পর্যারে সাজাবেন। এরপর সবচেয়ে সুবিধাজনক একটি সমাধানের পথ স্থির করা গেলে সেটি কতটা কার্যকরী হতে পারে সেটি পর্যালোচনা করে দেখবেন। সুবিধাজনক সমাধানের প্রয়োগ ও কাউন্সেলিং-এর সমাপ্তি ঘোষনা- উভয়ের দায়িত্ব খুবই পরিষ্কার। ক্লায়েন্টের দায়িত্ব হলো গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাজ করা এবং কাউন্সিলরের কাজ হলো কাউন্সেলিং এর আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘোষনা করা। পরবর্তীতে প্রয়োগের ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা দেখা দিলে ক্লায়েন্ট কাউন্সিলরের দ্বারা পুনরায় হতে পারেন।

I: Implementing the Decision (সিদ্ধান্ত ৰাস্তবায়ন):
কাউন্সেলিং-এর এই এপ্রোচের সর্বশেষ ধাপটি হচ্ছে গৃহীত সিদ্ধান্তের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য ব্যক্তিকে অবশ্যই সেটি অনযায়ী কাজ করতে হবে, নিজেকে ট্র্যাকে রাখতে হবে এবং কতটা ভালো করেছেন তা নিয়মিত নির্ধারণ করতে হবে। এই স্তরগুলোকে আমরা অ্যাকশন, নিশ্চিতকরণ ও মুল্যায়ন বলি। স্বিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কোনো সমস্যা হলে ব্যক্তিকে কাউন্সিলরের সহযোগীতা আবার নিতে হবে। কাউন্সিলর তখন সম্পুর্ন পদ্ধতিটি আবার পরীক্ষা করে দেখে সঠিক পথ খুঁজে পেতে ব্যক্তিকে সহযোগীতা করবেন। কাউন্সেলিং-এর অপর আরেকটি এপ্রোচ হলো GATHER. কাউন্সেলিং-এর মূলনীতি এক্ষেত্রেও মুলত একই।
আরও দেখুনঃ