জীবানুমুক্তকরণ ও নির্জীবকরণ

আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় জীবানুমুক্তকরণ ও নির্জীবকরণ  – যা অনুজীব বিদ্যা এবং এর প্রয়োগ এর অন্তর্ভুক্ত।

জীবানুমুক্তকরণ ও নির্জীবকরণ

 

জীবানুমুক্তকরণ ও নির্জীবকরণ

 

জীবাণুমুক্তকরণ (Sterilization) : জীবাণুমুক্তকরণ এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে সমস্ত জীবাণু স্পোরসহ ধ্বংস করা বা সরিয়েফেলা হয়।

নির্জরণ (Disinfection):

নির্জীবকরণ এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে জীবণুগুলোর সংখ্যা কমিয়ে ফেলা হয় যাতে এরা প্রদাহ সৃষ্টি করতে না পারে। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সব জীবাণু ধ্বংস হয়না কিছু জীবাণু ও স্পোর বেঁচে থাকে। এ পদ্ধতিকে ব্যাকটেরিওস্ট্যাটিক পদ্ধতিও বলে। আবার, ব্যাকটেরিওসাইভালে জীবাণু পূর্ণাঙ্গ ধ্বংস হয়। যেমন: তাপ ও বিকিরণ পদ্ধতি।

নির্জকারক (Disinfectants)

বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক পদার্থ যা নির্জীবকরণে ব্যবহার করা হয়। জীবাণুক্তকরণ পদ্ধতি: প্রধানত দুই প্রক্রিয়ায় জীবাণুযুক্ত করা হয়-

ক) ভৌত প্ৰক্ৰিয়ায় জীবাণুমুক্তকরণ (Physical sterilization)

১) ভাগ জীবাণুমুক্তকরণ প্রক্রিয়া (Heat)-

২) বিকিরণ জীবাণুমুক্তকরণ প্রক্রিয়া (Radiation)

খ) রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় জীবাণুমুক্তকরণ (Chemical sterilization),

তাপ জীবাণুমুক্তকরণ প্রক্রিয়া (Heat)-

তাপ হলো জীবাণুমুক্তকরণের সবচেয়ে দ্রুত ও কার্যকরি প্রক্রিয়া। অতিরিক্ত তাপমাত্রায় কোষের প্রোটিন জমাট বেধে অণুজীব মারা যায়। অল্প তাপমাত্রায় অণুজীব বিপাকীয় কাজে স্থবিরতা আসার ফলে জীবাণু দমন করা সহজ হয়। তাপের ধরনের উপর ভিত্তি করে দুইটি পদ্ধতি বিদ্যমান-

ক) কম তাপে জীবনুমুক্তকরণ (১০০° সেলসিয়াস তাপমাত্রার কম)

খ) উচ্চ তাপে জীবাণুমুক্তকরণ (১০০° সেলসিয়স তাপমাত্রার বেশি)

ক) কম তাপে জীবাণুমুক্তকরণ

১) পান্ডুরীকরণ (Pasteurization):

এই পদ্ধতিতে দুধকে একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায়, নির্দিষ্ট সময় ধরে গরম করা হয় যাতে দুধে অবস্থিত সকল জীবাণু মারা গেলেও দুধের রং, গন্ধ ও পুষ্টি মান অপরিবর্তিত থাকে। পাস্তুরীকরণ প্রক্রিয়ায় যেসব জীবাণু ধ্বংস হয়- মাইকোব্যাকটেরিয়াম বোভিস (Mycobacterium bovis), ই-কোলাই (E.coli), ব্রুসেলা (Brucella) ইত্যাদি।

পান্ডুরীকরণ পদ্ধতি

I. ফ্লাস পদ্ধতি (Flash method)- এ পদ্ধতিতে তাপ দেওয়া হয় ৭২° সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ১৫ সেকেন্ড ধরে।

II. হোল্ডিং পদ্ধতি (Holding method) এই পদ্ধতিতে তাপ দেওয়া হয় ৬৩°- ৬৬° সেলসিয়াস তাপমাত্র পর্যন্ত এবং ৩০ মিনিট ধরে।

২) সেরাম ঘনকরণ (Serum Inspissation):

এই পদ্ধতি সংগঠিত হয় ৭৫° থেকে ৮৫° সেলসিয়াস এর মধ্যে। এই পদ্ধতিতে জমাট বাধা ছাড়াই প্রোটিণ শক্ত করে ফেলা হয়। যে সব কালচার মিডিয়াতে সিরাম থাকে তাদের এই প্রক্রিয়ায় জীবাণুমুক্ত করা হয়।

খ) উচ্চ তাপে জীবাণুমুক্তকরণ: ২টি প্রক্রিয়ায় করা হয়।

১) শুষ্কতাপ (Dry heat)

সাধারণত ১৬০° সেলসিয়াস তাপমাত্রায়, এক ঘন্টা ধরে, শুষ্ক জায়গায় তাপ দেওয়া হয় যাতে সকল জীবাণু ধ্বংস হয়ে যায়।

শুষ্কতাপের জীবাণুমুক্তকরণ কার্যপ্রনালী

I. প্রোটিন বিকৃতিকরণ (Protein denaturation)

II. অক্সিজেন ঘটিত ক্ষতি (Oxidative damage)

III. লবনের বিষক্রিয়া (Toxic effect of electrolyte )

কয়েকটি শুষ্কতাপের জীবাণুমুক্তকরণের উদাহরণ

i. জলন্ত শিখা (Flaming)

নির্ধারিত বস্তুকে আগুনের শিখার উপরে রাখ ধীরে ধীরে গরম করে গনগনে লাল রং ধারনা করার মাধ্যমে জীবাণুমুক্ত করা হয়।

ii.  হট এয়ার ওভেন (Hot air oven )

এই প্রক্রিয়ায় ১৬০ সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এক ঘন্টা ধরে রাখা হয়। কাচের তৈরী পাত্র, কাঠি, সিরিঞ্জ; পাউডার ও তৈলাক্ত জিনিষ এর মাধ্যমে জীবাণু মুক্ত করা হয়। হট এয়ার ওভেন বিদ্যুৎ বা গ্যাস চালিত হতে পারে।

III. অবলোহিত বিকিরণ (Infrared irradiation)

এ প্রক্রিয়ায় ১৮০ সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ৭.৫ মিনিট ধরে উত্তপ্ত করা হয়। তাপরোধী বস্তু, ধাতব ও কাঁচের যন্ত্রপাতি, ধারালো বস্তু ছাড়াও ঘরের মেঝে, দেওয়াল, আসবাবপত্রের পৃষ্ঠ অবলোহিত বিকিরণের মাধ্যমে উত্তপ্ত করে জীবানুমুক্ত করা হয় |

২) আদ্র তাপে জীবাণুমুক্তকরণ (Sterilization by Moist Heat) আদ্রতা বা বাতাসে জলীয় বাষ্পের সাহায্যে তাপ সঞ্চালন করে জীবাণু ধ্বংস করা হয়।

আদ্র তাপের জীবাণুমুক্তকরণ কার্যপ্রণালী

I. জীবাণুর প্রোটিন ভেঙ্গে দেয় ও জমাট বাধায়,
II. ডিএনএ সুত্ৰক গুলোকে ভেঙে দেয়,
III. জীবাণুর কোষ পর্দা নষ্ট করে।

কয়েকটি আদ্র তাপের জীবাণুমুক্তকরণের উদাহরণ

i. জলগাহ (Water bath): এ প্রক্রিয়ায় ১০০ সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ৩০ মিনিট ধরে পানিতে সিদ্ধ করা হয়। এর মাধ্যমে সমস্ত ব্যাকটেরিয়া ও তাদের স্পোর ধ্বংস হয়েযায়। এর কারণ, ১০০ সেলসিয়াস তাপমাত্রায় বাস্পীভূত তাপ, একই তাপমাত্রায় শুষ্ক তাপের চেয়ে বিদ্ধকারী ও বিধংসী শক্তি বেশি।

ii. বাষ্পীয় জীবাণুমুক্তকরণ (Steam sterilizer): এ প্রক্রিয়ায় ১০০ সেলসিয়াস তাপমাত্রায় স্বাভাবিক বায়ুমণ্ডলীর চাপে বাষ্প (Steam) বস্তুর উপর দিয়ে প্রবাহিত করা হয়। ।

iii. অটোক্লেভ (Autoclave): এই প্রক্রিয়ায় ১২১ সেলসিয়াস তাপমাত্রায়, ৩০ থেকে ৬০ মিনিট ধরে, প্রতিতে ১৫ পাউন্ড/বর্গ ইঞ্চি চাপে বাষ্পের সাহায্যে তাপ দেওয়া হয়। এর মাধ্যমে সকল জীবাণু ও স্পোর ধ্বংস হয়ে যায়। বাষ্পের চাপ বেশি হলে নিরাপত্তা ভালোবের সাহায্যে অতিরিক্ত বাষ্প বের করে দেওয়া যায়। শৈল্য চিকিৎসার কাজে ব্যবহৃত বস্তু এর মাধ্যমে জীবাণুমুক্ত করা হয়।

 

google news logo
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

 

বিকিরণের মাধ্যমে জীবাণু ধ্বংস করণ (Sterilization by radiation)

বিভিন্ন রশ্মির বিকিরণ জীবাণুমুক্ত করতে সক্ষম । এই রশ্মিগুলো ডিএনএ ধ্বংস করতে পারে।

উধাহরন- গামা রশ্মি (Gamma ray), আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মি (Ultraviolet ray), এক্স-রে (x-ray) প্রভৃতি।
গামা রশ্মি (Gamma ray): জীবানুমুক্তকরণে ব্যবহার করা হয়।

ক) ডিসপোজেবল সিরিঞ্জ খ) নিডল। গ) ট্রান্সফিউশন উপকরণ ঘ) বায়োলজিকাল দ্রব্যাদি।
আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মি (Ultraviolet ray ) : সাধারণত ঔষধ শিল্পপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও বিশেষ করে অপারেশন থিয়েটার জীবানুমুক্ত করার কাজে ব্যবহার করা হয়।

ছাকন (Filtration):

নিচে উল্লেখিত ক্ষেত্রে জীবাণুমুক্তকরণ কাজে ছাকন পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। যেমন:

১। খাবার পানি বিশুদ্ধকরণ কাজে।

২। দ্রবীভূত পদার্থ জীবাণু থেকে আলাদা করতে

৩। ভাইরাস থেকে ব্যাকটেরিয়া আলাদা করতে।

৪। ভাইরাসের আকার সনাক্ত করতে।

৫। পরীক্ষার যন্ত্রপাতি বা মিডিয়া জীবাণুমুক্তকরণ কাজে।

রাসায়নিক প্রক্রিয়া (Chemical method):

১) ইথাইল এলকোহল (Ethyl alcohol):

রেক্টিফাইড স্পিরীট বা ৭০% ইথাইল এলকোহল জীবাণুমুক্তকরণ কাজে ব্যবহার করা হয়। ইথাইল এলকোহল জীবাণুর প্রোটিন জমাট বেঁধে দেয়, যার ফলে জীবাণু ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়

২) ফিনল এবং ডেটল (Phenol and Dettol)

: ফিনল এবং ডেটল জীবানু নাশক হিসাবে বহুল ব্যবহৃত যা জীবাণুর প্রোটিনকে জমাট বাধায়। বর্তমানে জীবাণুমুক্তকরণ কাজে শতকরা ১ থেকে ২ ভাগ ফিনল ব্যবহার করা হয়ে থাকে ।

৩) হ্যালোজেন (Halogen):

ক্লোরিন, ব্রোমিন ও আয়োডিনকে রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় হ্যালোজেন বলা হয়। এরা জীবাণু ধ্বংস করে। যেমন- ব্লিচিং পাউডারে ক্লোরিন থাকায় জীবাণু ধ্বংসের ক্ষেত্রে ব্লিচিং পাউডার ব্যবহার হয় ।

 

জীবানুমুক্তকরণ ও নির্জীবকরণ

 

৪) ফরমালিন বা ফরমাল্ডিহাইড (Formaldehyde):

ফরমালিন বা ফরমালডিহাইড স্পোরকে ধ্বংস করে থাকে। বাষ্পীয় ফরমাল্ডিহাইডের জীবাণু ধ্বংসকরার ক্ষমতা অত্যন্ত বেশী। ঘর বিছানা এবং কাপড়জীবাণুমুক্ত করতে ফরমাল্ডিহাইডের ব্যবহার করা হয়। ৪০% ফরমালিডিহাইড জীবাণুমুক্ত করার কাজে ব্যবহৃত হয়।

আরও দেখুন:

Leave a Comment