আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় প্রাথমিক চিকিৎসার মৌলিক ধারণা – যা প্রাথমিক চিকিৎসা সহায়তা এর অন্তর্ভুক্ত।
প্রাথমিক চিকিৎসার মৌলিক ধারণা
প্রাথমিক চিকিৎসা কি?
কোনো দুর্ঘটনায় হঠাৎ আহত বা অসুস্থ ব্যক্তিকে ডাক্তার বা হাসপাতালে পাঠানোর আগে তাৎক্ষণিকভাবে যে সেবা দেওয়া হয় তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা বা First Aid বলা হয়। যিনি প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদান করে থাকেন তিনি একজন প্রাথমিক চিকিৎসক বা ফার্স্ট এইডার (First Aider). প্রাথমিক চিকিৎসার উদ্দেশ্য: প্রাথমিক চিকিৎসার মূলনীতি ৩টি। যথা:
১। আহত বা অসুস্থ ব্যক্তির জীবন বাচাতে সাহায্য করা।
২। অবস্থার অবনতি রোধ করা।
৩। অবস্থার উন্নতি করা এবং উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা।
প্রাথমিক চিকিৎসার কার্যন্তর
১। রোগ নির্ণয় (উপসর্গ, লক্ষণ ও ঘটনার বিবরণ থেকে) ।
২। শুশ্ৰূষা বা সেবা প্রদান।
৩। হাসপাতাল বা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে স্থানান্তর।
প্রাথমিক চিকিৎসার নীতি
১। মাথা ঠাণ্ডা রেখে দ্রুত কাজ করা। ২। প্রাথমিক চিকিৎসক ডাক্তার নন।
প্রাথমিক চিকিৎসকের গুণাবলি ও দায়িত্ব
একজন প্রাথমিক চিকিৎসক যেকোনো ব্যক্তিই হতে পারেন। তবে প্রাথমিক চিকিৎসক হতে ইচ্ছুক ব্যক্তির কিছু বৈশিষ্ট্য থাকা আবশ্যক। যথা-
১। ঠান্ডা মাথায় দ্রুত পরিস্থিতি যাচাই করা ।
২। নিজের নিরাপত্তা সম্পর্কে সচেতন থাকা
৩। সংক্রমণ প্রতিরোধে সচেষ্ট থাকা ।
৪। আহত বা অসুস্থ ব্যক্তির অবস্থা যাচাই করা ।
৫। দ্রুত প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদান করা ।
৬। হাসপাতাল, চিকিৎসক বা সংশ্লিষ্ট সংস্থার সাথে যোগাযোগ করা
৭। নিজের অবস্থান সম্পর্কে সচেতন থাকা ।
৮। স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে আস্থা যাচাই করা।
৯। প্রতিবেদন তৈরি করা।
আহত বা অসুস্থ ব্যক্তির অবস্থা যাচাই করা
দুই স্তরের পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে একজন আহত বা অসুস্থ ব্যক্তির অবস্থা যাচাই করা হয়ে থাকে। যথা-
১। প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ: জীবনের জন্য হুমকিস্বরূপ বিষয়সমূহ উপস্থিত আছে কিনা; যেমন: শ্বাসপ্রশ্বাস
ও রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে আছে কিনা।
২। পরবর্তী পর্যবেক্ষণ: সাথা থেকে পা পর্যন্ত ভালো করে দেখা। সর্বোপরি লক্ষণ থেকে সমস্যা নির্ণয়
করা।
প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ
একজন মানুষের বেঁচে থাকার জন্য আমাদের শরীরে গুরুত্বপূর্ণ দুটি তন্ত্র (System) হচ্ছে শ্বাসতন্ত্র এবং রক্ত সঞ্চালন। তাই ব্যক্তির অবস্থার উপর নির্ভর করে কখনো কখনো প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ হিসেবে শ্বাস চলাচল ও রক্ত সঞ্চালন পরীক্ষা করা এবং যদি তন্ত্রগুলোর একটি বা উচ্চরই কার্যকর না থাকে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। বিষয়গুলো সহজে মনে রাখার জন্য ইংরেজি ABCDE তিনটি আদ্যাক্ষর ব্যবহার করা যায়।
A- Airway (শ্বাসনালি খুলে দেওয়া):
শ্বাসনালি খুলে দিতে হবে। এক হাত কপালে ও অন্য হাতের আঙ্গুল থুতনিতে রেখে আহত/অসুস্থ ব্যক্তির মাথা আলতো করে পেছনে হেলিয়ে এবং হা করিয়ে দেখতে হবে যে মুখে কিছু আটকে আছে কিনা, থাকলে তা বের করে ফেলতে হৰে।

B. Breathing (শ্বাস-প্রশ্বাস পরীক্ষা করা)
শ্বাসনালি খোলা রেখে দেখা, শোনা ও অনুভবের মাধ্যমে স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস পরীক্ষা করা যায়। এটি সহজে মনে রাখার জন্য দেখা, শোনা, অনুভব করা (Look, Listen, Feel / Palpate) শব্দগুলো ব্যবহার করা হয়ে থাকে:
- Look (দেখা)- বুক ওঠানামা করছে কিনা
- Listen (শোনা)- শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ হচ্ছে কিনা
- Feel Palpate (অনু)- নাক থেকে পরম বাতাস বের হচ্ছে কিনা।
C Circulation (র সঞ্চালন)
ভালো করে খেয়াল করতে হবে শরীরের কোথাও প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছে কিনা। সক্তক্ষরণ হলে তা দ্রুত বন্ধ করতে হবে। অন্যথায় আহত ব্যক্তির জীবননাশের হুমকি স্বরুপ রক্ত সঞ্চালন বাধাগ্রস্থ হয়ে শক এ আক্রান্ত হতে পারে।
D- Disablity (পঙ্গুত্ব বা অঙ্গহানি)
এক্সিডেন্ট বা দুর্ঘটনায় কোনো অঙ্গহানী হয়েছে কিনা তা পর্যবেক্ষণ করা এবং যদি হাত-পা ভেঙ্গে গিয়ে থাকে তাহলে সেটাকে যথাসম্ভব সোজা অবস্থায় বেঁধে দ্রুত হাসপাতালে নেয়া।
E- Exposure (রক্ত সঞ্চালন
এক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তি যদি অজ্ঞান হয় তাহলে তার প্রধান সমস্যা চিহ্নিত করার জন্য শরীরের কাপড় অপসারণ করে খুটে খুটে পর্যবেক্ষণ করা যে শরীরে আর কোথায় কোনো বড় ধরনের আঘাত বা ক্ষত আছে কিনা।
পরবর্তী পর্যবেক্ষণ
প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ সম্পন্ন করার পর ব্যক্তির সার্বিক অবস্থা যাচাই করার লক্ষ্যে মাথা থেকে পায়ের আঙ্গুল পর্যন্ত পরীক্ষা করা প্রয়োজন। এই অবস্থা যাচাই করার জন্য ঘটনার বিবরণ, ব্যক্তির উপসর্গ এবং লক্ষণসমূহ পরীক্ষা করা প্রয়োজন। সম্ভাব্য ক্ষেত্রে প্রাথমিক চিকিৎসক বিষয়সমূহ নোট করবেন যা ব্যক্তিকে হাসপাতালে প্রেরণ করলে মূল্যবান তথ্যসূত্র হিসেবে কাজ করবে।
বিবরণ সংগ্রহ
আহত বা অসুস্থ ব্যক্তি বা উপস্থিত লোকজনের কাছ থেকে প্রধানত দুটি বিষয়ে জানা প্রয়োজন; ঘটনার বিবরণ এবং যদি কোন রোগ থেকে থাকে তাহলে রোগের বিবরণ। বিবরণ সংগ্রহের কৌশল হিসেবে সহজে মনে রাখার জন্য ইংরেজী AMPLE ব্যবহার করা হয়।
- A (Allergy): ব্যক্তির কোনো কিছুতে এলার্জি আছে কি?
- M (Medical Problems & Medications): ব্যক্তি বর্তমানে কোনো ঔষধ গ্রহণ করছেন কি?
- P (Previous Medical History): উল্লেখ করার মতো অতীতে কোনো রোগ হয়েছিল কি?
- L (Last Event): সব শেষবার খাবার খেয়েছেন কখন?
- E (Event History): ঘটনাটা কি ঘটেছিল? কোনো রোগ সংক্রান্ত, নাকি দুর্ঘটনা?
গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণসমূহ পরিবীক্ষণ (Monitor) করা
একজন আহত বা অসুস্থ ব্যক্তিকে প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদানের পর তাঁর অবস্থা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে না আসা পর্যন্ত অথবা হাসপাতালে প্রেরণের পূর্ব পর্যন্ত তাকে পরিবীক্ষণে রাখা প্রয়োজন। যথাযথ পরিবীক্ষণের মাধ্যমে ঐ ব্যক্তির অবস্থা উন্নতি করা ও অবনতি রোধ করা সম্ভব হয়। নিচে পরিবীক্ষণের তিনটি বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-
ক) সাড়া দেওয়ার পর্যায় (Level of Response)
পর্যায়গুলো সহজে মনে রাখার জন্য AVPU আদ্যাক্ষরসমুহ ব্যবহার করা হয়।
- A (Alert to Shake): নড়াচড়া করার সাড়া দেয় কিনা
- V (Response to Voice): শব্দ করলে/ডাকাডাকি করলে সাড়া দেয় কিনা
- P (Response to Pain): চিমটি / হালকা ব্যথা দিলে সাড়া দেয় কিনা
- U (Unresponsive): কোনো কিছুতেই সাড়া না দেওয়া
খ. নাড়ি গতি ও শক্তি
নাড়ি গতি ও শক্তি মনিটর কর। এটা নিয়মিত কিনা, স্বাভাবিক বা দুর্বল কিনা, স্বাভাবিক গতির তুলনায় যুক্ত বা ধীর কিনা ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ করতে হবে। বিশ্ৰাম অবস্থায় নাড়ির স্বাভাবিক পতিও পরিমাপ করতে হবে।

গ. শ্বাস-প্রশ্বাস (ভি, গভীরতা)
শ্বাস-প্ৰশ্বাস (Breathing) নিয়মিত কিনা, শ্বাস-প্রশ্বাসে শব্দ হচ্ছে কিনা, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে কিনা এসব বিষয় নিবিড়ভাবে মনিটর করা ও নোট নেয়া। বয়সবেধে বিশ্ৰান্ত অবস্থায় শ্বাস-প্রশ্বাসের স্বাভাবিক গতি :

সংক্রমণ প্রতিরোধ
সংক্রমণ প্রতিরোধের বিষয়টি আহত বা অসুস্থ ব্যক্তি এবং প্রাথমিক চিকিৎসকের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। উত্তরেই পরিবেশ থেকে সংক্রমিত হতে পারেন। যেমন, আহত ব্যক্তির ক্ষত মাটি থেকে টিটেনাস জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত হতে পারে।
প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদানকালীন প্রাথমিক চিকিৎসক নিজেও আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারেন এবং তিনিও টিটেনাস জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত হতে পারেন। আবার উত্তরে একে অপরের কাছ থেকে সংক্রমিত হতে পারেন যাকে ক্রস ইনফেকশন (Cross Infection) বলা হয়ে থাকে।
যেমন রক্ত বা দেহ রসের মাধ্যমে এইচআইভি, হেপাটাইটিস বি এবং সি ভাইরাস ছড়াতে পারে। তাই একজন প্রাথমিক চিকিৎসককে সংক্রমণ প্রতিরোধের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে প্রয়োগ করতে হবে।
আরও দেখুন: