আজকের আলোচনার বিষয়ঃ মানব শ্বসনতন্ত্র। যা পেশেন্ট কেয়ার টেকনিক ১ এর বেসিক হিউমান বায়োলোজি ও এর প্রয়োগ অংশের অন্তর্গত।

মানব শ্বসনতন্ত্র
শ্বসন (Respiration):
জীবন ধারণের জন্য চলন, ক্ষয়পুরণ, বৃদ্ধি, প্রজনন প্রভৃতি জৈবিক কাজগুলো সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য শক্তির প্রয়োজন। এ শক্তির প্রধান উৎস সূর্যালোক। সালোক সংশ্লেষণের মাধ্যমে উদ্ভিদ সৌরশক্তিকে শর্করা জাতীয় খাদ্যবস্তুর মধ্যে স্থিতি শক্তিরূপে (Potential energy) সঞ্চিত করে। এই শক্তি জীব তার জীবন ধারণের জন্য সরাসরি ব্যবহার করতে পারে না।
শ্বসনের সময় জীবদেহে এই স্থিতি শক্তি রাসায়নিক শক্তি (ATP) হিসেবে তাপরূপে মুক্ত হয় এবং জীবের বিভিন্ন শরীরবৃত্তীয় কাজের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি যোগায়। শর্করাজাতীয় খাদ্যবস্তু ছাড়াও প্রোটিন, ফ্যাট এবং বিভিন্ন জৈব এসিড শ্বসনিক বস্তুরূপে ব্যবহৃত হয়। জীবদেহে এই জটিল যৌগগুলো প্রথমে ভেঙে সরল যৌগে পরিণত হয় এবং পরে জারিত হয়ে রাসায়নিক শক্তিতে (ATP) রূপান্তরিত হয়।

শ্বসনের প্রকারভেদ:
শ্বসনের সময় অক্সিজেনের প্রয়োজনীয়তার ভিত্তিতে শ্বসনকে দুভাগে ভাগ করা হয়। সেগুলো হচ্ছে সবাত শ্বসন ও অবাত শ্বসন।
সবাত শ্বসন (Aerobic respiration)-
যে শ্বসন প্রক্রিয়ায় অক্সিজেনের প্রয়োজন হয় এবং শ্বসনিক বস্তু (শর্করা, প্রোটিন, লিপিড, বিভিন্ন ধরনের জৈব এসিড) সম্পূর্ণভাবে জারিত হয়ে CO2, H2O এবং বিপুল পরিমাণ শক্তি উৎপন্ন করে, তাকে সবাত শ্বসন বলে। সবাত শ্বসনই হলো উদ্ভিদ ও প্রাণীর স্বাভাবিক শ্বসন প্রক্রিয়া।
অবাত শ্বসন (Anaerobic respiration)-
যে শ্বসন প্রক্রিয়া অক্সিজেনের অনুপস্থিতিতে হয়, তাকে অবাত শ্বসন বলে।

মানব শ্বসনতন্ত্র:
অক্সিজেন জীবন ধারণের অপরিহার্য উপাদান। মানবদেহে বাতাসের সাথে অক্সিজেন ফুসফুসে প্রবেশ করে এবং রক্তের মাধ্যমে দেহের সব অংশে পৌঁছায়। দেহকোষে পরিপাক হওয়া খাদ্যের সাথে অক্সিনের বিক্রিয়া ঘটে, ফলে তাপ এবং শক্তি উৎপন্ন হয়। অক্সিজেন এবং খাদ্য উৎপাদনের মধ্যে বিক্রিয়ার ফলে কার্বন ডাই-অক্সাইড ও পানি উৎপন্ন হয়। এ উপাদানগুলোকে ফুসফুসে নিয়ে যায়। সেখানে অক্সিজেন শোষিত হয় এবং কার্বন ডাই-অক্সাইড ছেড়ে দেয়। যে প্রক্রিয়া দিয়ে অক্সিজেন গ্রহণ এবং কার্বন ডাই-অক্সাইড নিষ্কাশন করা হয়, তাকে শ্বাসকার্য বলে।
যে জৈবিক প্রক্রিয়া প্রাণিদেহের খাকসুকে বায়ুর অক্সিজেনের সাথে জৱিত করে মজুত শক্তিকে ব্যবহারযোগ্য শক্তিতে রূপান্তর এবং কার্বন ডাই-অক্সাইড নিষ্কাশন করে, তাকে শাসন বলে। দেহের ভিতর গ্যাসীয় আদান-প্রদান একবার ফুসফুসে এবং পরে দেহের প্রতিটি কোষে পর্যায়ক্রমে সম্পাদিত হয়। শ্বসন ছাড়া আমাদের পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়, তিন-চার মিনিটের বেশি দেহে অক্সিজেনের সরবরাহ বন্ধ থাকলে মৃত্যু অনিবার্য। শ্ব
সনতন্ত্রকে কাজের উপর ভিত্তি করে দু ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-
ক) পরিবহণকারী অংশ ;
খ) শ্বসনকারী অংশ ।
ক) পরিবহণকারী অংশ:
শ্বসনতন্ত্রের এই অংশটি কতকগুলো বায়ু পরিবহণকারী নালী নিয়ে গঠিত যা দেহের বহিঃপরিবেশ ও ফুসফুসের গ্যাসীয় বিনিময়স্থলের মধ্যে সংযোগ করে। এটি নিম্নবর্ণিত অংশগুলো নিয়ে গঠিত। ১) নাক বা নাসিকা (Nose) ২) গলবিল (Pharynx) ৩) ল্যারিংক্স (Larynx) ৪) শ্বাসনালী বা ট্রাকিয়া (Trachea) ৫) ব্রঙ্কাই (Bronchi)

১। নাসিকা (Nose):
নাক হচ্ছে অস্থি, তরুণাস্থি, পেশি ও যোজক কলানির্মিত একটি ফাপা অঙ্গ। এর ত্বক অসংখ্য তেল গ্রন্থি ও কিছু লোমবিশিষ্ট। ত্বকটি সম্মুখে নাসাছিদ্র অতিক্রম করে নাকের ভেস্টিবল ( Vestibule) এ প্রসারিত। এখানকার এপিথেলিয়াম স্তরীভূত ও আঁইশাকার এবং কতকগুলো শক্ত লোমবাহী। নাসিকার অন্তঃস্থ গহবরটি নাস গহবর (Nasal cavity) যা একটি পাতলা ব্যবধায়কে ডান ও বাম অর্ধে বিভক্ত। এর প্রাচীর সিলীয় এপিথেলিয়ামে আবৃত, মিউকাস ঝিল্লি বেষ্টিত এবং রক্ত বাহিকা ও স্নায়ু প্রান্ত সমৃদ্ধ। নাসা গহবরের উপরের অংশের মিউকাস ঝিল্লি সংবেদী অলফ্যাক্টরী কোষযুক্ত।
নাসিকার কাজ:
নাসিকা প্রশ্বাস বায়ু প্রবেশে সাহায্য করে; প্রশ্বাস বায়ুতে যে সব ধুলিকণা বা রোগজীবাণু থাকে, লোম ও শ্লেষ্মাঝিল্লি সেগুলোকে আটকে রাখা এবং ছাকনির মতো কাজ করে; নাসাপথ অতিক্রমকারী বাতাস কিছুটা গরম ও আর্দ্র হয়ে ফুসফুসে প্রবেশ করে।
২। গলবিল (Pharynx):
নাসাগহবর পিছনদিকে দুটি ছিদ্র পথে নাসাগলবিল (Nasopharynx) এ উন্মুক্ত হয়। এরপর বাতাস মুখগলবিল (Oropharynx) অতিক্রম করে ল্যারিংক্সে প্রবেশ করে।
৩। স্বরযন্ত্র বা ল্যারিংক্স (Larynx) :
এটি গলবিলের নিম্নাংশের সামনের দিকে অবস্থিত এবং শ্বাসনালীতে উন্মুক্ত ও ছোট ছোট খণ্ডবিশিষ্ট তরুণাস্থি নির্মিত অংশ। তরুনাস্থিগুলো অস্থি সংযোজক সন্ধি-বন্ধনী ও ঝিল্লিতে আবদ্ধ। উপরিভাগের তরুণাস্থির উপরে এপিগ্লটিস (Epiglottis) নামে একটি জিহবাকৃতির ঢাকনা থাকে। ল্যারিংক্সের গহবরে একজোড়া স্থিতিস্থাপক, পর্দার মত স্বরতন্ত্রী (Vocal cord) থাকে।
ল্যারিংক্সের কাজ:
খাদ্য গ্রাসের সময় এপিগ্লটিস (উপজিহবা) স্বরযন্ত্রকে ঢেকে রাখা, যাতে খাদ্যদ্রব্য ল্যারিংক্সে স্বরযন্ত্রে প্রবেশ করতে না পারে; স্বরতন্ত্রীর কাঁপনের ফলে স্বরের উৎপত্তি হয়। কথা বলতে বা কোনো শব্দ উচ্চারণ করতে মুখ স্বরতন্ত্রী একসাথে ব্যবহৃত হয়।
৪। ট্রাকিয়া বা শ্বাসনালী (Trachea):
এটি লিগামেন্ট সংযুক্ত কতগুলো অর্ধবৃত্তাকার তরুনাস্থি নির্মিত প্ৰায় ১২ সেন্টিমিটার লম্বা ও ২ সেন্টিমিটার ব্যাসবিশিষ্ট ফাঁপা নল। এর পশ্চাৎ প্রাচীর নরম এবং যোজক কলার ঝিল্লি নির্মিত ও অন্ননালী সংলগ্ন। ট্রাকিয়ার অন্তর্গাত্র মিউকাস ঝিল্লিতে আবৃত। এতে মসৃণ পেশিতন্তু, সিলিয়া ও মিউকাস-নিঃসারী গ্রন্থি থাকে। শ্বাসনালীর বহিঃপ্রাচীর যোজক কলার ঝিল্লি দ্বারা আবৃত।
ট্রাকিয়া বা শ্বাসনালীর কাজ:
শ্বাসনালীর মাধ্যমে বাতাস দেহের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে; বিরক্তিকর কোনো বস্তু ট্রাকিয়ায় ঢুকে গেলে ঝিল্লির সূক্ষ্ম রোম কাশির উদ্রেক করে তা উপরের দিকে পাঠিয়ে দেয় এবং ট্রাকিয়া পরিষ্কার রাখা।
৫। ব্রঙ্কাই (Bronchi):
ট্রাকিয়া বক্ষ গহবরে প্রবেশ করে ৪র্থ বা ৫ম থোরাসিক কশেরুকার লেভেলে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যে দুটি শাখার সৃষ্টি করে, তাদের ব্রঙ্কাই বলে। প্রথম সৃষ্ট এ ডান ও বাম শাখাকে ব্রঙ্কাই (Bronchi) বলে। এরা যথাক্রমে ফুসফুসের ডান ও বাম খণ্ডে প্রবেশ করে অসংখ্য ক্ষুদ্রতর শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে। এদের বলে ব্রঙ্কিওল (Bronchiole )। ব্রঙ্কাইয়ের প্রাচীর ট্রাকিয়ার মতই। ডান শাখাটি বাম শাখা অপেক্ষা চওড়া কিন্তু খাটো।

খ) শ্বসনকারী অংশ:
শ্বসনকারী অংশের অঙ্গসমূহ যা ফুসফুসের ভেতরে থাকে :
ব্রঙ্কিওল (Bronchiol); এলভিওলার নালী (Alveolar duct); এলভিওলাই ( Alveoli)
১) ব্রঙ্কিওল
মানুষের ফুসফুস বক্ষ গহবরে ডায়াফ্রামের উপরে হৃদপিণ্ডের দুইপাশে অবস্থিত হালকা লাল রঙের কোণাকার অঙ্গ। ফুসফুসের অভ্যন্তরে অবস্থিত শাখা নালীগুলোকে ব্রঙ্কিওল বলে। ব্রঙ্কিওলের প্রান্তে ফুসফুসের শ্বসন অঞ্চল অবস্থিত। এটি অসংখ্য এলভিওলার থলি নিয়ে গঠিত। মানবদেহে ডান ও বাম এ দুটি ফুসফুস (Lungs) রয়েছে। এ দুটি আবার খাঁজের সাহায্যে খণ্ডে (Lobe) বিভক্ত। ডান ফুসফুস তিন খণ্ডবিশিষ্ট এবং বাম ফুসফুস দুই খণ্ডবিশিষ্ট।
২) এলভিওলার নালী
ব্রংকিওলের অতিসূক্ষ্ম ও তরুণাস্থিবিহীন প্রান্তগুলোকে এলভিওলার নালী (Alveolar duct) বলে। প্রতিটি নালী একেকটি এলভিওলার থলিতে (Alveolar sac) উন্মুক্ত হয়। ৩) এলভিওলাই প্রতিটি এলভিওলার থলি কতকগুলো এলভিওলাই (Alveoli) নিয়ে গঠিত। ফুসফুসের বহির্তল দ্বিস্তরী ভিসেরাল প্লুরা (Visceral pleura) ঝিল্লিতে আবৃত।
এলভিওলাসের গঠন:
ফুসফুসে স্কোয়ামাস এপিথেলীয় কোষে গঠিত ও কৈশিক জালিকাসমৃদ্ধ প্রকোষ্টের মত গ্যাসীয় বিনিময় তলকে একবচনে এলভিওলাস এবং এক কথায় এলভিওলাই বলে। মানুষের ফুসফুসে প্রায় ৭০- ৮০ বর্গমিটার আয়তনের তল জুড়ে ৭০০ মিলিয়ন (৭০ কোটি) এরও বেশি সংখ্যক এলভিওলাই রয়েছে। প্রত্যেক এলভিওলাসের প্রাচীর অত্যন্ত পাতলা, মাত্র 0.1 um (0.000১ মিমি) পুরু। এর বহির্দেশ ঘন, কৈশিক জালিকা সমৃদ্ধ কৈশিক নালিকা গুলো পালমোনারী ধমনী থেকে সৃষ্টি হয়। পরে এগুলো পুনর্মিলিত হয়ে পালমোনারী শিরা গঠন করে)।
প্রাচীরটি আর্দ্র স্কোয়ামাস (আঁইশাকার) এপিথেলিয়াম নির্মিত। এতে কোলাজেন ও ইলাস্টিক তন্তুও রয়েছে। ফলে শ্বসনের সময় সংকোচন-প্রসারণ সহজতর হয়। এভিওলাস-প্রাচীরের কিছু বিশেষ কোষ প্রাচীরের অন্তঃতলে ডিটারজেন্ট (Detergent ) -এর মত রাসায়নিক পদার্থ ক্ষরণ করে। এ পদার্থকে সারফেক্ট্যান্ট (Surfactant) বলে।
সারফেক্ট্যান্টের কাজ
- এ পদার্থ এলভিওলাস-প্রাচীরের তরল পদার্থের পৃষ্ঠটান (Surface tension) কমিয়ে দেয়, ফলে। শ্বাস-প্রশ্বাসের সময় ফুসফুস কম পরিশ্রমে সংকুচিত ও প্রসারিত হতে পারে।
- এ পদার্থ বাতাস ও অ্যালভিওলাস-প্রাচীর সংলগ্ন তরল পদার্থ O2 ও CO2 এর দ্রুত বিনিময়ে সাহায্য করে।
- এ পদার্থ অ্যালভিওলাসে আগত জীবাণু (ব্যাকটেরিয়া) ধ্বংস করে।
আরও দেখুনঃ