আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় রোগীকে সাজসজ্জা ও পোষাক পরিধান (গ্রুমিং ও ড্রেসিং) করতে সহযোগীতা করা – যা দৈনন্দিন কর্মকান্ডে সহযোগিতা এর অন্তর্ভুক্ত।
রোগীকে সাজসজ্জা ও পোষাক পরিধান (গ্রুমিং ও ড্রেসিং) করতে সহযোগীতা করা

একজন অসুস্থা বৃদ্ধ রোগী তার দৈনন্দিন জীবনের অনেক কাজই নিজ থেকে করতে পারেন না যেমন, নখ কাটা, সেভ করা, জুতা পড়া, চুল আচরাণো ইত্যাদি। নিজ থেকে পোষাক পরিধান ও সঠিক ফেক্স চরনেও তারা অনেক সমস্যায় পড়ে থাকেন। তখন এসব কাজগুলো সঠিকভাবে করার জন্য নিবিড় সহযোগীতার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এই অধ্যায়ে আমরা এইসব বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করব।
পোশাক নির্বাচন
১। পছন্দ সহজীকরণ করতে হবে। আলমারী অতিরিক্ত পোশাক মুক্ত রাখতে হবে কারণ অতিরিক্ত পোশাক থেকে পছন্দ করার সময় ব্যক্তি অনেকসময় উত্তেজিত ও বিভ্রান্ত হতে পারে।
২। আরামদায়ক (সুতি বা লিনেন) এবং সাধারণ পোশাক চয়ন করতে হবে। পুলওভার টপসের চেয়ে সামনে থাকা বোতাসসহ কার্ডিগানস, শার্ট এবং ব্লাউজ পরানো সহজ। বোতাম, র্যাপ বা জিপার্সের জন্য ভেলক্রো
বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
৩। নিশ্চিত করতে হবে, যে পোশাকগুলো ঢিলা-ঢালা ও আরামদায়ক, বিশেষত কোমর ও পশ্চাৎদেশে। কোমল এবং প্রসারিত হয় এমন কাপড়গুলো চরন করতে হবে।
৪। আরামদায়ক জুতা চয়ন করতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে যে, ব্যক্তির ঐ জুতা পড়ে যেন পিছলে না যায়। বাহিরে যাওয়ার জন্য লোফার বা ভেলক্রোসহ জুতা চয়ন করা নিরাপদ।
৫। নমনীয় হয়ে বুঝতে হবে, যদি ব্যক্তি একই পোশাক বারবার পরতে চান, তবে অনুরুপ গোলাক করেকটি কিনে চিহ্নিত করে রাখতে হবে যেন পরিষ্কার করার সময় বিভ্রান্ত হতে না হয়।
পোশাক পরিধান করিয়ে দিতে করণীয়
১। প্রতিটি পোশাকের ধরন অনুযায়ী আলাদা করতে হবে। যেমন অন্তবাস প্রথমে, পরে প্যান্ট, পরে একটি শার্ট এবং তারপরে একটি সোয়েটার।
২।যদি সম্ভব হয়, তবে ব্যক্তিকে পছন্দসই পোশাক বা রঙ নির্বাচন করার সুযোগ দিতে হবে, তবে ব্যাপারটি সহজতর করার জন্য দুটি বিকল্প পছন্দ দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে।
৩। সরল ও সরাসরি নির্দেশনা দিতে হবে। সম্ভব হলে নিজে নিজের পোশাক পরতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। একটি একটি করে পোশাক এগিয়ে দিয়ে তার নির্দেশনা স্পষ্ট করে বলতে হবে।
৪। আবহাওয়া অনুযায়ী যথাযথ পোশাক পরিধানে ব্যক্তিকে উৎসাহিত করতে হবে।
৫। ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম ব্যবহার করতে হবে।
পরিধানরত পোশাক অপসারণের কৌশল
১। রোগীর যদি বাহু বা কাঁধে আঘাতপ্রাপ্ত হন, তবে আঘাতহীন দিক থেকে জামা খুলতে শুরু করতে হবে
২। জামা খুলতে, বোতম/জিপার/ভেলক্রো খুলে জামাটি পিছন দিকে নীচে থেকে উপরের দিকে নিয়ে আসতে হবে। কাঁধটি সামান্য উঁচু করে ধরে হাতা খুলে ফেলতে হবে। অপর পাশের হাতা তারপর এক টান দিয়ে খোলা যাবে।
৩। প্যান্ট খুলার জন্য, কোমরের কাছে আলগা করে বোতাম বা চেইন থাকলে খুলে ফেলতে হবে। প্যান্টটি কোমরের অংশটি ধরে নীচের দিকে টেনে খুলে দিতে হবে।
পোশাক পরানোর কৌশল
১। রোগী যদি বাহু বা কাঁধে আঘাতপ্রাপ্ত হন, তবে আঘাতপ্রাপ্ত দিক থেকে জামা পরাতে শুরু করতে হবে। হবে।অপর হাতটি ধরে সহজেই পরিয়ে দেওয়া যাবে। সেবাদানকারীর হাতটি জামার হাতার মধ্য দিয়ে নিয়ে তার হাতটি ধরে ভেতরে ঢুকাতে সাহায্য করতে
২। প্যান্ট পরানোর জন্য, সেবাদানকারীর হাতটি প্যান্টের পায়ের অংশের ভেতর দিয়ে কোমর পর্যন্ত নিয়ে রোগীর পা ধরে ভেতর দিকে নিয়ে আস্তে হবে। তার প্যান্টটি কোমর পর্যন্ত টেনে তুলে বোতাম/জিপার/ভেলক্রো/ ফিতা লাগিয়ে দিতে হবে।
প্রয়োজনীয় সাজসজ্জা (গ্রুমিং)-এর প্রথমিক পরিকল্পনা
শারীরিক বা মানসিক ভাবে অসুস্থ বা বয়সজনিত কারণে শারীরিক ক্রিয়াকলাপের নিয়ন্ত্রণ হারানো কোনো ব্যক্তির চুল কীভাবে আঁচড়াতে হয়, নখ কাটতে হয় বা শেভ করতে হয় তা ভুলে যেতে পারেন। এক্ষেত্রে কিছু প্রাথমিক পরিকল্পনা প্রয়োজন। যেমন :
১। সাজসজ্জার রুটিনগুলো গ্রাহকের পরিবারের সাথে কথা বলে বা সম্ভব হলে গ্রাহকের সাথে কথা বলে জেনে নিতে হবে।
২। পরিবারের সাথে কথা বলে বা সম্ভব হলে গ্রাহকের সাথে কথা বলে তার প্রিয় প্রসাধনী সামগ্রীর ব্যাপারেও জেনে নিতে হবে এবং সেগুলোই ব্যবহার করতে হবে।
৩। ব্যক্তির পাশাপাশি সেবাদানকারী তার নিজের সাজসজ্জার কাজগুলো সম্পাদন করে নিতে পারে। যেমন- নিজের চুল আঁচড়ানো
৪। বিপদমুক্ত ও সহজতর সাজসজ্জার সরঞ্জাম ব্যবহার করতে হবে। যেমন- বৈদ্যুতিক শেভার, রেজারের চেয়ে কম ঝুঁকিযুক্ত হতে পারে।
মুখমণ্ডলের যত্ন
মুখমণ্ডল ধৌতকরণ
১। একটি অ্যালকোহলমুক্ত মৃদু ক্লিনজার/ফেসওয়াশ ব্যবহার করতে হবে।
২। মুখমণ্ডল হালকা গরম পানিতে ভিজিয়ে ক্লিনজার/ফেসওয়াশ প্রয়োগ করতে আঙ্গুল ব্যবহার করতে হবে।
৩। ক্লিনজার/ফেসওয়াশ প্রয়োগের ক্ষেত্রে নিন্মোক্ত নির্দেশনা অবলম্বন করতে হবে:
ক। ত্বক স্ক্রাব করা থেকে বিরত থাকতে হবে, কারণ স্ক্রাবিং ত্বককে অতিরিক্ত শুষ্ক করে।
খ। হালকা গরম পানি দিয়ে ধুয়ে স্পঞ্জ করে মুছে একটি নরম তোয়ালে দিয়ে চেপে চেপে শুকনো করে মুছে ফেলতে হবে।
গ। ত্বক শুষ্ক বা ত্বকে চুলকানি হলে ময়েশ্চারাইজার লাগিয়ে দিতে হবে ।
ঘ। দিনে দুইবার (সকালে একবার এবং রাতে একবার) এবং অতিরিক্ত ঘামের পরে মুখমণ্ডল ধৌতকরণ সীমাবদ্ধ করতে হবে। বিশেষত যখন টুপি বা হেলমেট পরার ফলে ত্বক জ্বালা করে। অতিরিক্ত ঘাম হওয়ার পরে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ত্বক ধুয়ে দিতে হবে।
পুরুষদের ক্ষেত্রে মুখমণ্ডলে শেভিং
প্রভুতি:
১। রোগী বাসায় শেভিং করতে ইচ্ছুক না হলে, সেলুনে করতে ইচ্ছুক কিনা তা জেনে নিতে হবে।
২। প্রথমে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যে, ঘরে যথেষ্ট পরিমাণে আলো আছে যাতে দু’জনকেই ভালোভাবে দেখতে পারা যায়। ব্যক্তিকে তার প্রয়োজন অনুসারে চেয়ারে বসতে বা বিছানায় বসতে সাহায্য করত হবে। তবে রোগী যদি শয্যাশায়ী হন, তবে শুয়ে থাকা অবস্থায় শেভিং করতে হবে।
৩। প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সংগ্রহ করতে হবে। যেমন- একটি আয়না, একটি রেজার বা বৈদ্যুতিক শেভার, শেভিং ক্রিম, একটি পরিষ্কার তোয়ালে এবং গরম পানির একটি পাত্র।
শেভিং প্রক্রিয়া:
১। শুরু করার আগে, ব্যক্তির চিবুকের নীচে একটি তোয়ালে রেখে পানির ফোঁটাগুলো আটকাতে হবে। দাঁড়ি নরম করতে হালকা গরম পানিতে তোয়ালে বা স্পঞ্জ ভিজিয়ে মুখ ধুয়ে নিতে হবে।
২। শেভিং ক্রিম প্রয়োগ করতে হবে।
৩। একটি ভালো রেজার ব্যবহার করতে হবে, যেন রেজার দ্বারা কেটে যাওয়ার গুরুতর ঝুঁকি এড়ানো যায়।
৪। দাঁড়ির বৃদ্ধি যেদিকে সেদিক বরাবর লেভ করতে হবে।
৫। প্রবীণদের ত্বক পাতলা এবং খুব সংবেদনশীল। তাই সংক্ষিপ্ত এবং ধীর গতির স্ট্রোক ব্যবহার করতে হবে।
সর্বদা ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করতে হবে, “আপনার কেমন লাগছে?” বা “আপনার কি কোনো অসুবিধা হচ্ছে?”।
৬। অ্যাডামস্ আপেল, মুখ, নাক এবং চিবুকের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।
৭। ২-৩ টি স্ট্রোকের পরে প্রতিবার রেজারের ফলকটি ধুয়ে ফেলতে হবে।
৮। অবশিষ্ট শেভিং ক্রিম সরানোর জন্য একটি উষ্ণ ভেজা কাপড় ব্যবহার করতে হবে। পরিষ্কার কাপড় দিয়ে ত্বক শুকিয়ে নিতে হবে।
চুলের যত্ন
১। রোগী চুল বাসায় কাটাতে ইচ্ছুক না সেলুনে, তা জেনে নিতে হবে। বাসায় কাটাতে ইচ্ছুক হলে চুল কাটে এমন ব্যক্তিকে বাসায় আনার ব্যবস্থা করতে হবে।
২। চুল ছোট এবং একটি সহজ স্টাইলে রাখতে হবে। গ্রাহকের ব্যক্তিগত পছন্দের সম্মান দিতে হবে।
৩। বাথটাব বা ঝরণায় খুব অসুবিধা হলে, রান্নাঘরের সিঙ্কে বা বাথরুমের বেসিনে চুল ধুয়ে দিতে হবে।
৪। চুল ধোঁয়া অসম্ভব হলে ওষুধের দোকানে পাওয়া যায়, এমন একটি শুকনো শ্যাম্পু ব্যবহার করার কথা
বিবেচনা করা যেতে পারে।
৫। যদি ব্যক্তি শয্যাশায়ী হন, তবে চুল অবশ্যই বিছানায় ধুতে হবে। একটি বড় প্লাস্টিকের শিট বালিশের উপর রেখে ব্যক্তিকে শুইরে ব্যক্তির ঘাড়ের নিচে একটি তোয়ালে ভাঁজ করে স্থাপন করতে হবে। প্লাস্টিকের শিটের অপর প্রাপ্ত একটি বালতিতে রাখতে হবে।
৬। ব্যক্তির ব্যক্তিগত চিরুনি ব্যবহার করতে হবে। চিরুনি নিয়মিত ছোট ব্রাশ দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে। ধারালো দাঁতযুক্ত চিরুনি স্কাল্পে আঘাত করতে পারে। একটি হালকা স্পর্শের চিরুনি ব্যবহার করে ব্যক্তিকে নিজের চুল নিজে আঁচড়াতে উৎসাহিত করতে হবে।

চোখের যত্ন
১। পরিষ্কার হালকা গরম পানিতে পাতলা ছোট রুমাল ভিজিয়ে চোখের পরিধি (চোখের চারপাশের বৃত্তাকার অঞ্চল) ভালোভাবে মুছে দিতে হবে।
২। জ্বালাপোড়া এড়ানোর উদ্দেশ্যে এই অঞ্চলে সাবান ব্যবহার না করাই ভালো। চোখের ভিতরের কোণা থেকে বাইরের কোণার দিকে হাতের রুমালটি পরিচালিত করতে হবে।
৩। পরিষ্কার করার সময় প্রতিটি চোখের ক্ষেত্রে রুমালের ভিন্ন অংশ ব্যবহার করতে হবে কারণ এটি সংক্রমণের
বিস্তার রোধ করতে সহায়তা করে।
৪। চোখের মার্জিনের সাঁতসেঁতে ময়লা আলগা করতে তুলার বল ব্যবহার করতে হবে।
৫। চোখের বলের উপরে কখনও সরাসরি চাপ প্রয়োগ করা যাবে না। চোখ থেকে নয়লা সাবধানে অপ করা উচিত এবং যতবার প্রয়োজন চোখ পরিষ্কার করা উচিত।
৬। অনেক রোগী চশমা পরেন। চশমাগুলো বিছানার পাশে ড্রয়ারে রাখা উচিত। ডিমেনশিয়া আক্রান্ত ব্যক্তিরা প্রায়শই চশমা কোথায় রেখেছেন ভুলে যান, তাই সর্বদা তাদের চশনা একই জায়গায় রাখতে হবে।
৭। চশমা পরিষ্কার করার সময় যত্নবান হতে হৰে যেন চশমা ভেঙ্গে না যায়। উষ্ণ পানি এবং একটি নরম কনো কাগজ দিয়ে চশমা পরিষ্কার করে নিতে হবে।
কানের যত্ন
১। কানের মধ্যে পরিষ্কার করার জন্য একটি রুমালের পরিষ্কার কোণ ঢুকিয়ে আস্তে আস্তে ঘুড়াতে হবে। এছাড়াও, কান পরিষ্কার করার জন্য একটি কটন-বাটও দরকারী।
২। যদি রোগী শ্রবণ যন্ত্র ব্যবহার করে থাকেন, তা নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে। ব্যাটারির যত্ন এবং সঠিক
সন্নিবেশ কৌশল এই যন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত।
৩। শ্রবণশক্তি হ্রাস হল বয়স্কদের একটি সাধারণ স্বাস্থ্য সমস্যা। পরিবেশে সঠিকভাবে যোগাযোগ এবং প্রতিক্রিয়া জানাতে রোগী সক্ষম কিনা সে ব্যাপারে লক্ষ্য রাখতে হবে।

পায়ের যত্ন
নখ কাটায় সহায়তা করার জন্য নিয়মিত রুটিন ঠিক করতে হবে। নখের ধার কমানোর জন্য নেইল ফাইলার ব্যবহার করতে হবে। কোথাও কোনো ফোলা দাগ বা ডিসকোলেশন আছে কিনা তা খেয়াল করতে হবে।
আরও দেখুন: