আজকে আমরা শারীরিক পরীক্ষা বা ফিজিক্যাল এসেসমেন্ট সম্পর্কে আলোচনা করবো। যা পেশেন্ট কেয়ার টেকনিক ১ এর সাধারণ স্বাস্থ্য পরীক্ষা অংশের অন্তর্গত।

শারীরিক পরীক্ষা বা ফিজিক্যাল এসেসমেন্ট (Physical Assessment)
শারীরিক পরীক্ষা বা ফিজিক্যাল এসেসমেন্ট রোগীর রোগ নির্নয়ের জন্য চিকিৎসা ক্ষেত্রে ব্যবহৃত একটি অত্যাবশ্যকীয় কৌশল। ডাক্তার-নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীগণ কোনো রোগীর শারীরিক বিভিন্ন পরীক্ষা সম্পন্ন করার জন্য চারটি মৌলিক পদ্ধতি অনুসরণ করে থাকেন। এগুলো হচ্ছে:
ক. ইনস্পেকশন (Inspection):
ইনস্পেকশন এর অর্থ হলো চোখ দিয়ে দেখা। কোনো রোগীকে স্বাস্থ্য পরীক্ষার সময় চোখ দিয়ে দেখে (ভিশন) শরীরের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে সাধারণ কিছু ধারণা করা যায়। খালি চোখে আমরা রোগীর বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের অবস্থা, রঙ বা কালার, আকার-আকৃতি, গঠন বা টেক্সচার (Texture), প্রতিসাম্য ( Symettrey), নড়াচড়া প্রভৃতি বিষয় নির্নয় করতে পারি। এটি স্বাস্থ্য পরীক্ষার একেবারে প্রথম ধাপ। গুরুত্বপূর্ণ ভাইটাল সাইন শ্বাসপ্রশ্বাসের হারও আমরা ইন্সপেকশনের মাধ্যমে বুক ও পেটের উঠানামা দেখে পরিমাপ করে থাকি ।

খ. পালপেশন (Palpation):
পাললেশন মানে হলো রোগীর শরীর স্পর্শ করে পরীক্ষা করা। এই স্পর্শ বনা পালপেশন আবার দুই রকম: লাইট পালপেশন বা হালকা স্পর্শ এবং ডীপ পাললেশন বাঁ গভীর স্পর্শ। শরীরের কোনো অস্বাভাবিকতা বুঝার জন্য বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বা বডি পার্টস পালপেট করতে হয়।
লাইট পালপেশনের মাধ্যমে আমরা শরীরের উপরিভাগের গঠন, কোমলভা বা টেন্ডারনেস, টেমপারেচার বাঁ তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, স্থিতিস্থাপকতা, স্পন্দন, টিউমার প্রভৃতি পরীক্ষা করতে পারি। এটার জন্য হাতের আংগুলের ডগা (Finger Pad) দিয়ে খুব আলতোভাবে আধা ইঞ্চি পর্যন্ত চামড়ার উপর চাপ দেওয়া হয়। আবার ডীপ গালপেশনের ক্ষেত্রে চামড়ার উপর দিয়ে দেড় বাঁ দুই ইঞ্চি পর্যন্ত গভীর চাপ দেওয়া হয়।
অনেক সময় অধীক চাপ প্রয়োগের প্রয়োজন হলে দুই হাত একসাথে রেখে গভীর চাপ দেওয়া হয়। এর মাধ্যমে আমরা শরীরের ভিতরের অরগান যেমন কিডনী, পাকস্থলী প্রভৃতি অঙ্গের আকার-আকৃতি, ব্যথা ও এর প্রকৃতি, প্রতিসাম্যতা, অবস্থান ইত্যাদি বিষয় নির্নয় করতে পারি।

গ. পারকাশন (Percussion) :
পারকাশন বলতে আঙ্গুল বা হাত দিয়ে দ্রুত এবং তীক্ষ্ণভাবে রোগীর শরীরের বিভিন্ন অংশে টোকা দিয়ে পরীক্ষা করাকে বুঝায়। এর মাধ্যমে বিভিন্ন অঙ্গের অবস্থান, আকৃতি-প্রকৃতি, সীমানা, অবস্থান প্রভৃতি বিষয় সনাক্ত করা যায়। শরীরের কোনো অভন্তরীণ অঙ্গে যেমন কিডনি বা ফুসফুসে পানি বাঁ গ্যাসীয় পদার্থ আছে কিনা তা সনাক্ত করতেও পারকাশন ব্যবহার করা হয়। পারকেশন দুই প্রকার: ডাইরেক্ট বা সরাসরি পারকাশন এবং ইনডাইরেক্ট বা পরোক্ষ পারকাশন।
ভাইরেক্ট পারকাশনে হাতের একটি বাঁ দুটি আঙ্গুলের সাহায্যে রোগীর শরীরে সরাসরি টোকা দেওয়া হয়। আর ইনডাইরেক্ট পারকাশনে একটি হাত রোগীর শরীরে রেখে সেই হাতের উপরে অন্য হাতের আঙ্গুল দিয়ে একইভাবে টোকা দেওয়া হয়। উভয় ক্ষেত্রেই টোকার প্রকৃতি ও শব্দ লক্ষ করা হয়। রোগীর ব্যথা আছে কিনা সেটা রোগীকে জিজ্ঞেস করে এবং তার মুখায়াতব দেখেও ৰুয়া যায়। অনেক সময় বিশেষ একধরনের হাতুড়ি দিয়ে এটি করা হয়ে থাকে। এটিকে বলা হয় পারকাশন হ্যামার।
ঘ. অসকালটেশন (Auscultation):
স্টেথোস্কোপ নামক একটি বিশেষ যন্ত্রের সাহায্যে বিভিন্ন ইন্টার্নাল অরগান বা অভ্যস্বরীপ অঙ্গ যেমন: ফুসফুস, হার্ট বা হৃৎপিণ্ড কিংবা অম্লের শব্দ (বাওয়েল সাউন্ড) শোনার কৌশলকেই অসকালটেশন বলা হয়। এই শব্দের মাধ্যমে অরগানটি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায় যেমন, সেখানে পানি বাঁ গ্যাস জমে গেছে কিনা, অস্বাভাবিক কোনো ফিজিওলোজি আছে কিনা প্রভৃতি। এ জন্য একটু নিরিবিলি পরিবেশ হলে শব্দ ভালোভাবে শোনা যায়।

হেল্থ স্ক্রিনিং- এর গুরুত্ব ( Importance of Health Screening)
সুস্থ অসুস্থ সকলের জন্যই সাধারণ স্বাস্থ্য পরীক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। একটি নির্দিষ্ট সময় পর পর (সাধারণত ৬-১২ মাস) মানুষের শরীরে সুপ্ত কোনো রোগ আছে কি না তার পরীক্ষা করার নামই হেল্থ স্ক্রিনিং। অনেক দেশেই হেল্থ ইন্সুরেন্স-এর প্রচলন অটা না থাকায় কোনো সমস্যা দেখা না দিলে কেউ নিজের টাকা খরচ করে ডাক্তারের কাছে যেতে চান না। কিন্তু এই অসতর্কতা জীবনে অনেক সময় বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে। তবে প্রাপ্ত বয়স্ক বিশেষ করে যাদের বয়স ৪০ বছর বা তার বেশি তাদের জন্য হেল্থ স্ক্রিনিং অত্যন্ত জরুরি।
হেল্থ স্ক্রিনিং এর মূল বিষয় হচ্ছে যে সমস্ত রোগের প্রাথমিক অবস্থায় কোনো লক্ষণ থাকে না সেগুলোকে শনাক্ত করা। যেমন- ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্ত চাপ, কিডনীর সমস্যা, হার্টের সমস্যা, রক্তের চর্বি বা কোলেষ্টেরলের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া, রক্ত শূন্যতা, মূত্রনালীতে বা শরীরের অন্য যেকোনো জায়গায় ইনফেকশন, পেটের ভিতরে পিত্তথলি, কিডনি ও মূত্রথলিতে পাথর, জরায়ুর সমস্যা ইত্যাদি রোগসমূহ হেল্থ স্ক্রিনিং এর মাধ্যমে অনেক প্রাথমিক অবস্থায় শনাক্ত করা যায়। হেল্থ স্ক্রিনিংএ সাধারণত সিবিসি- (কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট), ফাস্টিং ব্লাড সুগার, সেরাম ক্রিয়েটিনিন, ইউরিন আরএমই, ইসিজি, আল্ট্রাসনোগ্রাফি, লিপিড প্রোফাইল ইত্যাদি করতে দেওয়া হয়। এসব টেস্টের মাধ্যমে কোনো রোগের প্রাথমিক অবস্থা অথবা কারো কোনো পূর্বের অসুখ থাকলেও তার অবস্থা জানা যায়।

শরীরের লুকিয়ে থাকা অসুখ জটিল আকার ধারণ করার আগেই হেলথ স্ক্রিনিং করা খুবই প্রয়োজন। তবে একজন কেয়ারগিভার হিসেবে আমরা মানবদেহের তাপমাত্রা, নাড়ির গতি, ব্লাড প্রেসার, প্রস্বাসের হার-শ্বাস প্রভৃতির মাধ্যমেই হেল্থ স্ক্রিনিং এর প্রাথমিক কাজ সমাপন্ন করবো। এগুলোকে বলা হয় ভাইটাল সাইন্স বাঁ মানবদেহের অত্যাবশ্যকীয় লক্ষণসমূহ। এর পাশাপাশি মানবদেহের উচ্চতা, ওজন, বডি ম্যাস ইনডেক্স, তরল পদার্থের ইনটেক ও আউটপুট দেখা, রক্তের গ্লুকোজ ও অক্সিজেনের পরিমাণ ইত্যাদিও হেল্থ স্ক্রিনিং এর অন্তর্ভুক্ত।
যেগুলো একজন কেয়ারগিভার সহজেই তার কর্মক্ষেত্রে অনুশীলন করতে পারে। এ ধরনের পরীক্ষা সাধারণত কোনো রোগ সরাসরি ডায়াগণসিস করে না, এটা অনুমেয় স্বাস্থ্য ঝুঁকির উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি প্রকাশ করতে সাহায্য করে।
আরও দেখুনঃ
1 thought on “শারীরিক পরীক্ষা বা ফিজিক্যাল এসেসমেন্ট (Physical Assessment)”