আজকের আলোচনার বিষয়ঃ রক্তচাপ পরিমাপের পদ্ধতি। যা পেশেন্ট কেয়ার টেকনিক ১ এর সাধারণ স্বাস্থ্য পরীক্ষা অংশের অন্তর্গত।

রক্তচাপ পরিমাপের পদ্ধতি
অসুস্থ রোগীদের ক্ষেত্রে ডাক্তারের নির্দেশনা মোতাবেক রক্তচাপ মাপা হয়ে থাকে। রক্তচাপ মাপার জন্য স্ফিগমোমেনোমিটার নামক যন্ত্র ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এটি মূলত তিন প্রকারের হতে পারে।
ক. এনারয়েড স্ফিগমোমেনোমিটার
খ. পারদ স্ফিগমোমেনোমিটার ও
গ. ডিজিটাল স্ফিগমোমেনোমিটার
এনারয়েড স্ফিগমোমেনোমিটারের সাহায্যে রক্তচাপ পরিমাপের জন্য স্টেথিস্কোপ নামক যন্ত্রের প্রয়োজন হয় যার সহায়তায় শব্দের মাধ্যমে সিস্টোলিক ও ডায়াস্টোলিক রক্তচাপ নির্ধারণ করা হয়। ডিজিটাল থার্মোমিটার সরাসরি রক্তচাপ পরিমাপ করে একটি ডিজিটাল স্ক্রিনে ফলাফল প্রদর্শন করে। পক্ষান্তরে পারদ স্ফিগমোমেনোমিটারে ফলাফলটি প্রদর্শিত হয় একটি পারদ মিটারে।

তবে হাসপাতাল, ক্লিনিক বা অন্যান্য সেবাদানকেন্দ্রে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এনারয়েড স্কিপমোনেনোমিটারের বহুল ব্যবহার দেখা যায়। নিচে একটি আদর্শ এনারয়েড স্ফিগমোমেনোমিটারের বিভিন্ন অংশ সম্পর্কে আলোচনা করা হলঃ
১। বিপি বা ব্লাড প্রেসার কাফ (BP Cuff or Blood Pressure Cuff):
এটি একটি ইনফ্ল্যাটেবল ব্যাগ যা ধমনীকে আটকানোর জন্য হাতকে সংকুচিত করতে ব্যবহৃত হয়। সঠিকভাবে ব্র্যাকিয়াল আর্টারিকে নির্ধারণ করার জন্য রোগীর বয়স ও শারীরিক অবস্থা অনুযায়ী সঠিক সাপের বিপি কাফ ব্যবহার করতে হয়। বয়স্ক ও শিশুদের জন্য পৃথক বিপি কাফ ব্যবহার করতে হয়। প্রাপ্তবয়স্ক রোগীর জন্য বাহুর জাকারের উপর নির্ভর করে ১২*২২ সে.সি. থেকে শুরু করে ১৬-৪২ সে.মি. পর্যন্ত হতে পারে। আবার বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এটি ৪৮ থেকে ১১৮ সে.মি. পর্যন্ত হতে পারে।
২। ইনফেশন বাল্ব (Inflation Bulb):
এয়ার রিলিজ বাল্ব বন্ধ রেখে ইনফ্লেশন বাল্ব হাত দিয়ে চেপে চেপে বিপি কাফের ভিতরে প্রয়োজন অনুযায়ী বাতাস প্রবেশ করানো যায়।
৩। এয়ার রিলিজ বাল্ব (Air Release Bulb):
এয়ার রিলিজ বাঘের মাধ্যমে বিপি কাজের ভিতরে বাতাসের আসা যাওয়া নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
৪। এনায়েত ফ্যানোমিটার (Anaroid Manometer):
এটি একটি চাপ পরিমাপক যন্ত্র যেটি মি. মি. পারদ চাপ এককে রক্ত চাপ পরিমাপ করে।
৫। টিউব কানেক্টর (Tube Connector):
টিউৰ কানেকটরের সাহায্যে এনাররেড ম্যানোমিটার ও ইনফ্লেশন বাঘ বিপি কাফের সাথে সংযুক্ত হয়। এর মাধ্যমে বাতাস ভিতরে প্রবেশ করে ও বাহিরে যার আবার চাপের কারণে ম্যানোমিটারের কাটা উঠা নামা করা যায়।

স্টেথোস্কোপ (Stethoscope):
স্টেথোস্কোপ হলো মানুষ অথবা প্রাণিদেহের হৃদস্পন্দন কিংবা অন্যান্য অভ্যন্তরীণ শব্দ শোনার জন্য ব্যবহৃত একটি যন্ত্র। এটি প্রধানত হৃদস্পন্দন এবং নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ শুনতে ব্যবহার করা হয়। তবে এটি অন্ত্র, ধমনী এবং শিরার রক্ত বয়ে চলার শব্দ শোনার জন্যও ব্যবহৃত হয়।
প্রকারভেদ: স্টেথোস্কোপ বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
১. Acuortic Stethoscope:
আমাদের দেশের চিকিৎসকেরা সচরাচর এই ধরনের স্টেথোস্কোপ ব্যবহার করেন। বাজারে বিভিন্ন কোম্পানির একুয়ান্টিক থার্মোমিটার পাওয়া যায়।
২. Electronic Stethoscope:
এ ধরনের স্টেথোস্কোপ শব্দতরঙ্গকে বৈদ্যুতিক সংকেতে পরিণত করে সেটিকে জ্যাস্প্রি-ফাই করে জোরালো ও পরিষ্কার শব্দে পরিণত করে।
৩. Noise Reduction Stethoscope:
এ ধরনের স্টেথোস্কোপ চারপাশের অপ্রয়োজনীয় নয়েজ বাদ দিয়ে কেবল কাংখিত শব্দ শুনতে সাহায্য করে।
৪. Recording Stethoscope:
এর সাহায্যে শুভ শব্দকে রেকর্ড করে রাখা যায় এবং পরবর্তীতে ধারনকৃত শব্দ বিশ্লেষণ করে রোগ নির্ণয় করা হয়।
৫. Fetal Stethoscope:
গর্ভাবস্থায় ভ্রুনের হৃদস্পন্দন শুনতে এ ধরনের স্টেথোস্কোপ ব্যবহার করা হয়।

স্টেথোস্কোপের নানাবিধ ব্যবহার থাকলেও চিকিৎসকেরা মূলত: রোগ নির্ণয়ের কাজেই এটি ব্যবহার করেন। রোগীর Clinical Examination এর চারটি ধাপের মধ্যে একটি হচ্ছে Auscultation, যা স্টেথোস্কোপের সাহায্য ছাড়া প্রায় অসম্ভব। নিচে একটি স্টেথিয়োগের বিভিন্ন অংশ সংক্ষেপে বর্ণনা করা হলো:
১। ইয়ারপিস (enrpiece):
এই অংশটি কানের মধ্যে প্রবেশ করানোর পর ডায়াফ্রাম চালু থাকলে শরীরের অভ্যন্তরীণ শব্দসমূহ শোনা যায় ।
২। টিউবিং
এটি একটি নমনীয় রাবার টিউব যেট ভায়াক্রাম দ্বারা গৃহীত শব্দ ইয়ারপিসের মাধ্যমে আমাদের শ্ৰবণযন্ত্রে পৌঁছে দেয়।
৩। বেল:
বেল বা ঘণ্টা ডায়াফ্রামের উল্টো পাশে লাগানো থাকে এবং এটি মৃদু ও অমসৃন শব্দ শুনতে সাহায্য করে। এটিকে ঘুরিয়ে ভারাক্রানের মুখ খোলা বা বন্ধ করা যায়।
৪। ডায়াফ্রাম:
ডায়াফ্রাম বা মধ্যচ্ছদা স্টেথোস্কোপের এমন একটি সমতল অংশ যেটি রোগীর শরীরের বিভিন্ন অংশে স্পর্শ করাতে হয়। এটিই মূলত শব্দ গ্রহণ করে টিউবের মাধ্যমে আমাদের কানে পৌঁছে দেয়।

রক্তচাপ মাপার পদ্ধতি:
১। সঠিক নিয়মে হ্যান্ড ওয়াশ করে নিতে হবে।
২। স্টেথোস্কোপের এয়ার পিস ও ডায়াফ্রাম জীবানুমুক্ত করে নিতে হবে।
৩। ব্লাড প্রেসার মনিটর ঠিক আছে কিনা তা পরীক্ষা করে নিতে হবে।
৪। রোগীকে আরামদায়কভাবে বসিয়ে অথবা শুইয়ে নিতে হবে।
৫। রক্তচাপ মাপার জন্য চাপবিহীন অবস্থায় বিপি কাফের নিচের প্রায় কনুইয়ের সামনের ভাঁজের ২.৫ সেঃমি উপরে ভালোভাবে আটকিয়ে নিতে হবে।
৬। কনুইয়ের সামনে হাত দিয়ে ব্রাকিয়াল ধমনীর অবস্থান স্থির করে তার উপর স্টেথো ক্ষোপের ভায়াগ্রাম ৰসিয়ে নিতে হবে।
৭। ডায়াফ্রামটি এমনভাবে আলতো করে চাপ দিতে হবে যেন ডায়াফ্রাম এবং ত্বকের মাঝখানে কোনো ফাকা না থাকে।
৮। চাপ মাপার সময় স্টেথোস্কোপ কিংবা কাফের ওপরে হাত না রেখে কাজ করতে হবে।
৯। ব্যারোমিটারের ঘড়ি হৃদপিণ্ডের সাথে একই তলে অবস্থান করিয়ে নিতে হবে।
১০। এরপর রেডিয়াল ধমনী অনুভব করে ধীরে ধীরে ইনফ্লেশন বালের সাহায্যে বিপি কাফটি ফুলিয়ে চাপ বাড়াতে হবে।
১১। রেডিয়াল পালস বন্ধ হওয়ার পর ব্যারোমিটারে চাপ ৩০ মি. মি. উপরে নিতে হবে।
১২। তারপর আস্তে আস্তে চাপ কমাতে হবে। প্রতি বিটে সাধারণত ২ মি. মি. চাপ কমানো যেতে পারে।
১৩। এবার চাপ কমানোর সময় স্টেথোস্কোপ দিয়ে ব্রাকিয়াল ধমনীতে সৃষ্ট শব্দ মনোযোগের সঙ্গে শুনো। চাপ কমতে শুরু করলে রক্ত চলাচলের ফলে এক ধরনের শব্দ সৃষ্টি হয়। একে করটকফ শব্দ (Korotkoff sound) বলা হয়। করটকফ শব্দ খাপে খাপে পরিবর্তন হয়।
১৪। প্রথমে এক ধরনের যে তীক্ষ্ণ শব্দে পাওয়া যায় এটাকে সিস্টোলিক রক্তচাপ হিসেবে কাউন্ট করতে হবে।
১৫। করটকফ শব্দের তীক্ষ্ণতা ধীরে ধীরে কমে আসতে আসতে এক সময় প্রথম পর্যায়ের শব্দ থেমে যায়। এই শব্দ বন্ধ হওয়ার আগে যে শব্দ শোনা যায় সেটাকেই ডায়াস্টোলিক রক্তচাপ হিসেবে কাউন্ট করতে হবে।
১৬। বিপি মেশিন খুলে ফেলে পরিমাপ করা ব্লাড প্রেসার রেকর্ড চার্টে লিপিবদ্ধ করতে হবে। কাজ শেষে বিপি ইন্সট্রুমেন্ট নির্ধারিত জায়গায় সংরক্ষণ করে রাখতে হবে এবং কোনো অসুবিধা থাকলে চিকিৎসক বা নার্সকে অবহিত করতে হবে।
আরও দেখুনঃ